লেখাটি খুলনা জেলার একাধিকবার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের ৭ম প্রধান শিক্ষক প্রয়াত জনাব শেখ ইমাম উদ্দিন কে নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক।
তাঁর প্রতিটি ছাত্রের হৃদয়ে এমন হাজারো সুপ্ত স্মৃতি বিদ্যমান, যা লিখে প্রকাশ করলে মহাকাব্যে রূপ নিবে।
প্রাত্যুষের সুখনিদ্রাটা কেবলি জাকিয়া আসিয়াছে এমন সময় বজ্রনাদ ঘঠিল, না আকাশ হইতে নহে, পিতার বজ্রকন্ঠ হইতে। এক লম্ফে উঠিয়া দেখি পিতৃদেব স্বয়ং সম্মুখে আবির্ভূত, দক্ষিণ হস্তে মাসাধিক পূর্বে প্রস্ফুটিত চারিটি মুরগির ছানা তারস্বরে তাহাদের মাতৃক্রোড় বিচ্যুতির প্রতিবাদ জানাইতেছে। আড় চোখে দেয়ালে অবিরাম ছুটিয়া চলা ঘড়িটির দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহার বৃহৎ দণ্ডটি ১২ এবং ক্ষুদ্রটি ৬ নম্বর দাগের উপর পৌঁছাইতে বাহানা করিতেছে। হাকিয়া ডাকিয়া এই প্রত্যুষে নিদ্রা ভঙ্গের হেতু কী? তাহা জিজ্ঞাসিত হইবার পূর্বেই তিনি বলিলেন, “হেড স্যার অসুস্থ, আমি আর তোমার মা দেখতে গিয়েছিলাম, তুমি এখন গিয়ে দেখে আস আর এই মুরগির বাচ্চা গুলো দিয়ে আস।“ শুনিয়া আমার মাথায় বজ্রপাত ঘঠিল, উহা পিতার কন্ঠ হইতে নহে, আমার মস্তিষ্ক ধমনীর বেগে।
আমার পিতা যাঁহাকে হেডস্যার বলিয়া সম্বোধন করিলেন তিনি দক্ষিণ বাংলার বিদ্যাদুগ্ধ নিঃসরণী বিদ্যামাতা – কপিলমুনি সহচারী বিদ্যামন্দিরের ৭ম প্রধান শিক্ষক। তিনি আমার পিতা, মাতা, সকল পিতৃব্য ও মাতৃব্যগণেরও জ্ঞ্যানদেব ছিলেন । তাঁহার প্রতি আমার যতটা না প্রণয় ছিল তাঁহার অধিক ছিল ভয় আর ভক্তি । কিন্তু আমার পিতামাতার ভক্তির পরিমান নিন্মোক্ত ঘটনাগুলি পড়িয়া পাঠক নিজেই বুঝিতে সক্ষম হইবেন।
হেডস্যার যশোর শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের নিয়মিত প্রধান পরীক্ষক ছিলেন, তাহার অনূদিত ও লিখিত বহু ইংরেজি ব্যাকরণ ও পাঠ্যবই ছিল। ১০ম শ্রেণির দুই পত্র ইংরেজি পড়াইতেন, যেহেতু তাহারা মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী তাই ইংরেজির গুরুদায়িত্বটা নিজেই লইয়া থাকিতেন।
আমি তখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র, ইংরেজি শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনি কিছুদিন ক্লাসে আসিতেন। হাতের লেখা পড়িবার অযোগ্য হওয়ায়, আমাকে ইংরেজির ছোট ছাদের হাতের লেখা চর্চা করিবার আদেশ করিলেন। দুইদিন আমাকে দেখাইয়া দিলেন কিন্তু তৃতীয় দিবসেও একই ভুল করিলাম। মহাশয় ধৈর্যের বাঁধ বাঁধিয়া রাখিতে না পারিয়া সজোরে আমার কান বরাবর চপেটাঘাত কষিলেন। চপেটাঘাতের যন্ত্রণা লিখিয়া প্রকাশ করা সম্ভব নহে, পাঠকগণ এই পঙক্তিদ্বয় হইতে অনুমান করিয়া লইবেন“ কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে”। কানের ব্যথ্যা আর অভিযোগের কথা, উভয় লইয়া বাটীতে পৌঁছাইয়া মাতার অনুকম্পা লাভের আশায় ব্যথার চারিগুণ ক্রন্দন করিয়া নালিশ জানাইলাম যে, আমার অতি লঘু অপরাধে এই গুরুদণ্ড নেহাত অন্যায় বৈ আর কিছুই নহে। এক্ষণে ইহার বিহিত ব্যবস্থা না করিলে আমি বিদ্যার্জনে ইতি টানিবো।
বেতের বাড়ি নহে, চপেটাঘাত ! ইহা শুনিয়া মাতা বড়ই আপ্লূত হইয়া পড়িলেন, “আহা তিনি যখন আমার হাড় বজ্জাত পুত্রের গাত্রে স্পর্শ করিলেন, নিশ্চয় এবার সে মানুষ হইবে, তাহাকে আর গরু, গাধা সহ অন্যান্য নিকৃষ্ট পশুর নামে ডাকিতে হইবে না।“ ইহা শুধু তিনি ভাবিলেনই না অস্পষ্ট স্বরে প্রকাশও করিলেন। কিন্তু হেডস্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস দেখিয়া তাহার মাতৃ স্নেহ উবিয়া গেল। রুষ্ট নেত্রে ব্যাঘ্রকন্ঠে সাবধান করিয়া কহিলেন ইহার পুনরাবৃত্তি ঘটিলে, রন্ধনশালায় আমার ভাগের চাউল আর পৌঁছাইবে না, শোবার ঘরেও তালা পড়িবে। মাতার এই বিমাতা সুলভ আচরণ দেখিয়া অনুকম্পা লাভের আসায় পিতার শরণাপন্ন হইলাম। সকল শুনিয়া বিলাতি চুরোটের ধোঁয়া ছাড়িয়া পিতৃদেব কহিলেন, “তাঁহার…… বেত্রাঘাতের কারণেই…… আজ আমি বি, এ ক্লাস পার করিতে পারিয়াছি, নিজ হাতে যখন তোমাকে আঘাত করিয়াছেন…… তখন তুমি আমাকে ছাড়াইয়া যাইবে নিশ্চয়।“ আমি ফোন করিয়া আমার শাস্তির হেতু জানিতে চাইবার আর্জি করিলে পিতা কহিল“ তাঁহাকে ফোন করিব আমি ? এত বড় স্পর্ধা আমার নাই, তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইলে এখনো আমার পদযুগল আড়ষ্ট হইয়া যায়।“
মহাশয় আমাকে কিঞ্চিৎ স্নেহ করিতেন, তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন না থাকায় একদা তিনি আমার পিতাকে টেলিফোন করিয়া আমাকে প্রাত্যুষে তাঁহার বাসস্থানে উপস্থিত হইবার ফরমান জানাইলেন। পিতা রাত্রে আসিয়া উহা বলিলে সমস্থ রাত্র নিদ্রা দেবী আমার দুই নেত্র হইতে ছুটি লইয়া গেল। মহাশয়ের বাটীর সম্মুখে ঐ তিন খানা পরিপক্ক ইক্ষুর প্রতি যে লোলুপ দৃষ্টি দিয়াছিলাম, আর সুযোগ পাইলেই যে উহা হোস্টেলের গোপন কক্ষে লইয়া গিয়া চর্বণ করিব পরিকল্পনা করিয়াছিলাম। নিশ্চয় বেতের দু’ঘা বসাইয়া তাহা কারো নিকট হইতে ফাঁস করিয়া লইয়া উহাকে সাক্ষী মানিয়া, আমাকে বেতের অমৃত সেবনে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। মফেজ (মফেজ উদ্দীন সরদার, বর্ষীয়ান শিক্ষক ) স্যারের ক্লাসে ব্লাক বোর্ডে পাঠ লেখার পরিবর্তে অপ্রাসঙ্গিক কথা লিখিয়া, হাস্যরস সৃষ্টি করার তথ্য ফাঁস হইয়াছে, পেয়ারা ভক্ষণ, ফুল উৎপাটন, বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজনের চাঁদা লইয়া যে রাজভোগ খাইয়াছি, উহা নিশ্চয় বিষ্টু ময়রা ফাঁস করিয়া দিয়াছে।‘ মনে নানা ধরণের কূচিন্তা উপস্থিত হইল আর চোখের সম্মুখে মহশয়ের অগ্নি বিস্ফোরিত নেত্র আর চিরচেনা আড়াই হাত লম্বা শুঁকনো বেত খানি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। হঠাৎ পিতৃদেবের নিকট প্রশ্ন করিলাম – তুমি জিজ্ঞেস করোনি কেন , কি জন্য আমাকে ডাকিয়াছে ? “আমার এত দুঃসাহস নেই তাঁহার নিকট কৈফিয়ত তলব করার যে, কেন তোমাকে ডাকিয়াছে“ পিতার এই ৪৭ বছরে আসিয়াও মহাশয়ের প্রতি এত ভয় দেখিয়া আমার ভয় টা দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল। উহা বাড়িয়া চতুর্গুণ হইল যখন প্রাত্যুষে বন্ধু ও সতীর্থ শামিম (এইচ এম শামীম আহমেদ, সিনিয়র সেকশন অফিসার, কপিলমুনি কলেজ, এস এস সি ৯৪) আসিয়া দরজা চাপড়াইয়া জানাইল যে তাহার বিরুদ্ধেও উক্ত সমন জারি হইয়াছে। ইহা শুনিয়া আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে রাজভোগের তথ্য ফাঁস হইয়াছে, কারণ শামীমও উহার রস আস্বাদন করিয়াছিল। রস বাহির করিবার জন্য যে এই প্রাতঃনিমন্ত্রন, জানিয়া মোটা জিন্স প্যান্ট আর জাম্পার লাগাইয়া দূরু দূরু হৃদয়ে মহাশয়ের বাটীর সিংহদ্বারে আসিয়া হাজির হইলাম। ( সাধারণত আমরা হেডস্যারের বেতের বাড়ি থেকে রক্ষা পেতে মোটা জিন্স বা মোটা কাপড় পরতাম, কেউ ডাবল বা ট্রিপলও পরত)
মহাশয় হালকা ছাই রঙের কাশ্মিরি শাল গায়ে জড়াইয়া বারান্দায় বসিয়া তসবিহ জপিতেছিলেন, আমাদিগকে দেখিয়া শান্ত স্বরে কহিলেন “আয়”। কর্মকার তপ্ত লোহা জলে চুবাইলে যেমন পচ্ করিয়া শিতল হইয়া যায়, তেমনি এই দুই অক্ষরের ছোট্ট শব্দটি আমার দ্রুত কম্পিত হৃদয় স্পন্দন কে শিতল করিয়া শান্ত করিয়া দিল। বুঝিলাম ঘঠনা বেগতিক নহে। আমাদিগকে বসিবার স্থান চিহ্নিত করিয়া, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনী পরীক্ষার কিছু উত্তরপত্র আনিয়া উহার নাম্বারগুলো সঠিক ভাবে গুনিয়া লিখিবার নির্দেশ করিল। কোনভাবেই যেন কম বেশি না হয় এবং উহা মনুষ্য কেন, পক্ষিকুলও যেন না জানিতে পারে তাহা সতর্ক করিয়া দিল। কাজ শেষে সিংহের ন্যায় বুক ফুলাইয়া ফিরিয়া, মাতাকে রাজ্য জয়ের ইতিহাস শুনাইয়া নিজেক রাজা বানাইয়া তৃপ্ত হইলাম।
বসন্তের আগমনী ধ্বনি বাজিছে সমীরণে, চারিদিকে ঋতুরাজ বরণে সাজ সাজ রব । আম্রবোলের গন্ধে মৌ মৌ ধরণী । মুরগীর বাচ্চার চিউ চিউ ধ্বনির সাথে সমান বেগে পা চালাইয়া যখন স্কুল প্রাঙ্গণে পৌঁছাইলাম, দেখি একখানা সাদা রঙের মাইক্রবাস প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলিয়া গাড়ির নিকটে গিয়া দেখি হেডস্যারকে ধরাধরি করিয়া গাড়িতে তুলিতেছে। কেউ একজন বলিয়া উঠিল “স্যার এই স্ট্রোকে আপানার কিছু হবে না “স্যার চোখ খুলিয়া গাড়ির জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া শুধু দুইবার বলিল “আমার স্কুলটা দেখ“
“আমার স্কুলটা দেখ“ কথাটি আমার বুকে গিয়া বিঁধিল। পক্ষাঘাতগ্রস্থ মহাশয় এক কন্যা ও এক পুত্রের জনক । কন্যাটি সাতক্ষীরাতে তাঁহার শ্বশুরালয়ে থাকিয়া কলেজে ছাত্র পড়ায় আর পুত্রটি ঢাকায় অধ্যায়নরত ছিল, মহাশয় এই মুমূর্ষ অবস্থায় তাঁহার পুত্রকন্যার কোন কথা না বলিয়া শুধু স্কুলের কথা ভাবিলেন !
১৯৬২ সালে তিনি এই বিদ্যামন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে যোগদান করিয়াছিলেন। শুনিয়াছি তখন একখানা মাত্র ভবন (প্রশাসনিক ভবন) ও অমৃতময়ী টেকনিক্যাল স্কুল (বর্তমান অমৃতময়ী মিলনায়তন) লইয়া এই বিদ্যা সরোবর দক্ষিণবাংলায় বিদ্যাবারি প্রবাহিত করিয়া আসিতেছিল। দীর্ঘ ৪০ বৎসরের কর্মকালে আপন সংসার ত্যাগ করিয়া তিনি এই বিদ্যামহিয়সীকে অপরূপ সৌন্দর্যে সাজাইয়াছিলেন, উহা একখানা মাধ্যমিক স্কুল হইলেও প্রকান্ড দুইখানা মাঠ, দুইখানা ছাত্রাবাস, সুসজ্জিত তিনখানা বৃহদাকার একাডেমিক ভবন, প্রধান শিক্ষকের বাস ভবন, পাঠাগার, শিক্ষক মিলনায়তন, সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার (বিজ্ঞান ভবন), গোপন সংরক্ষণ কক্ষ, প্রধান শিক্ষকের সুসজ্জিত দপ্তর, সহকারী প্রধান শিক্ষকের দপ্তর, হিসাব শাখা, অত্যাধুনিক মিলনায়তন, পাতাল ছোয়া পুকুর, দৃষ্টিনন্দন শহীদমিনার আর স্কুল অধীনস্থ তিনখানা অত্যাধুনিক মার্কেট দেখিয়া দর্শনার্থী উহাকে আটোখাটো বিশ্ববিদ্যালয় বা বৃহৎ কোন মহাবিদ্যালয় বলিয়া ভুল করিতে পারেন বৈকি। মহাশয় আপন মনের মাধুরী মিশাইয়া ১ নং একাডেমিক ভবনের দোতলার দক্ষিণ পার্শ্বে একখানা অত্যাধুনিক অতিথিশালা সাজাইয়া ছিলেন। সরকারি যে কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্কুল বা অত্র অঞ্চল ভ্রমণে আসিলে এই অতিথিশালার আতিথেয়তা গ্রহণ করিতেন। মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালিন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এ ডি সি সহ অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ এই অতিথিশালায় তাসরীফ রাখিতেন । মহাশয়ের সহধর্মিণী (প্রয়াত জাহেদা খাতুন, সহকারী প্রধান শিক্ষক, কপিলমুনি মেহেরুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ) নিজ হাতে তাঁহাদের জন্য খাদ্যদ্রব্যাদি প্রস্তুত করিতেন।
প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে দন্ডায়মান একজোড়া কৃষ্ণচুড়া আকাশে মাথা ঠেকাইয়া অহর্নিশি বিদ্যা দেবীর আরতি করিত । সে অপরূপ দৃশ্য চর্ম চক্ষুতে অবলোকন না করিয়া বিদ্যামন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করা বৃথা । সেই আরাধনা আজি শ্রান্ত হইয়াছে , কোন এক কুক্ষণে তাহাদের কর্তন করা হইয়াছে।
স্ত্রী-সন্তান থাকিতেও তাঁহাকে সংসারত্যাগী বলিয়া অন্যায় করিয়াছি – বলিয়া সমালোচকেরা সমালোচনা করিতে পারেন বৈকি। তাহাদের সমালোচনার দণ্ড হইতে রক্ষা পাইতে, মহাশয়ের সংসার ত্যাগের কিছু উদাহরণ নিম্নে পেশ করিলাম ।
সতীর্থ রফিক ( ব্রাক কর্মকর্তা, এস এম রফিকুল ইসলাম, এস এস সি-৯৪) আফজাল (ইউ সেফ কর্মকর্তা, আফজাল হোসেন, এস এস সি-৯৪) ছাত্রাবাসে থাকিয়া পড়াশুনা করিত, ছাত্রাবাসে অনাবাসিক ছাত্রদের যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা ছিল। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অপ্রয়োজনকে প্রয়োজন বানাইয়া তাহদের নিকট যাওয়া হইত। আমাদিগকে দেখিয়া উহাদের চোখ ছানা বড়া হইয়া উঠিত, শশব্যস্ত হইয়া চারিদিকে তাকাইয়া দেখিয়া ফিস ফিস করিয়া বলিত “এক্ষণ যা, হেডস্যার দেখলে কিন্তু আজ আর নিস্তার নাই, কাল রাত ১টার সময় টুটুল ভাইকে বাইরে পেয়ে যে মাইর দিছে !“ -রাত ১টা! ও বাবা,তা উনি ঘুমায় না? ঢোক গিলিয়া কহিল, “ঘুমাবে কখন উনার তো আর ঘর সংসার নেই, তাই সারা দিন আমাদের পিছনে লেগে থাকে, উনি বাড়ি নাই শুনে সে দিন গিয়েছিলাম ৯টা থেকে ১২টার শো সিনেমা দেখতে, ১২টার সময় বের হয়ে দেখি, উনি হলের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, তারপর যে কি হয়েছে সে আর না বলি“
এস এস সি পরীক্ষার পূর্বে প্রায়ই মহোদয়ের এই অমানবিক আচরণ পরিলক্ষিত হইত, তিনি রাত্র দ্বিপ্রহরে পিয়ন অথবা অমিও স্যার ( অমিও রঞ্জন দে, বিজ্ঞান বিভাগের অভিজ্ঞ শিক্ষক, হোস্টেলেই থাকতেন, স্কুলের বিভিন্ন প্রয়োজনে হেডস্যারকে সর্বাধিক সহযোগিতা করতেন, হেডস্যারের অবসরের পর কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন, পরবর্তীতে কৃষ্ণকাঠি স্কুলের প্রধানশিক্ষের দায়িত্ব নেন) কে সঙ্গী করিয়া সিনেমা হল গেটে দণ্ডায়মান হইতেন। যদি কোন ছাত্র হল হইতে বাহির হইত তবে তাহার নাম লিখিয়া রাখিতেন এবং পরবর্তি স্কুল দিবসে, প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে তাহাদের আপিলের সুযোগ ছাড়াই বিচার কাজ সম্পন্ন করিয়া, বিচারক নিজেই শাস্তি প্রদান করিতেন। শাস্তি প্রদানের সময় সমস্ত স্কুল জানিতে পারিত যে, আজ মহশয়ের মস্তিষ্ক কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত হইয়াছে। শাস্তি গ্রহণের পর, গ্রহীতারা যে পরীক্ষার পূর্বে চিত্তবিনোদনের নিমিত্তে আর কখনো সিনেমার টিকিট ক্রয়ে অর্থ সঞ্চয় করিবে না, তাহা কিন্তু পণ করিয়াই লইত।
মধ্যরাত অবদি তিনি স্কুল অফিসেই কাজ করিতেন এর ফাঁকে হোস্টেলে পায়চারী । ক্যাডেট কলেজে ভর্তির নিমিত্তে , অমিও স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়িতে গিয়া প্রায়ই রাত্রে মহোদয়কে অন্ধকারে আবিস্কার করিয়া কম্পিত হৃদয়ে ভিন্ন পথ ধরিতাম । সকালে এক খানা ফুলের চারা বাছিয়া রাখিয়াছিলাম , রাত্রে প্রাইভেট পড়া শেষে উহা লইয়া যাইব । রাত্র ৯ টা, ফুলের চারা তুলিবার নিমিত্তে কেবল হাত বাড়াইয়াছি । হটাৎ আমার বদনে অনাকাঙ্খিত একখানা আলোক বর্ষন হইল , আর একখানা রক্ত হিম করা কণ্ঠস্বর বাজিয়া উঠিল “ কে ওখানে ? “ আমি , “ ওখানে কি ? “ কলম পড়ে গেছে , “ পেয়েছ ?” জ্বী , “এদিক দিয়ে যাও , ওদিকে অন্ধকার “ কোন দিকে অন্ধকার তাহা আর ঠাওর হইল না । বুকের ধকধকানি লইয়া স্কুল গেইট পার হইয়া রাস্তায় উঠিয়া দম ফেলিলাম ।
এক্স-টেনে অধ্যয়নকালে ক্লাস হইত মিলনায়তনে, একদা ক্লাসের জানালা দিয়া তাকাইয়া দেখি, মহাশয় সম্মুখের দ্বিতল ভবনের সানশেডে চড়িয়া বেত দিয়া দেওয়ালে আঘাত করিতেছেন। আশ্চর্য কান্ড, এই সানশেডে তো আমরাই ভাল ভাবে হাটিতে পারিব না, তাঁহার এই কর্মের হেতু কি? পরে জানিলাম রাজ মিস্ত্রীর কাজ তদারকি করিবার প্রয়াসে জনাবের এই আয়োজন। স্কুলের কাজে তিনি কাহাকেও ভরসা করিতে পারিতেন না।
৪.২২ একর (প্রায় ১৩ বিঘা) ব্যাপ্তির এই সৌন্দর্যধারিণী বিদ্যাপ্রাঙ্গণ ২৪ ঘন্টাই তাঁহার দুই নেত্রের গতিপথে থাকিত। বিশাল ফুল-ফলের সমারোহ ,বৃক্ষরাজি কিছুই তাহার চক্ষের অন্তরালে যাইত না। ছাত্রাবাস, মিলনায়তন, বিজ্ঞানাগার ও শৌচাগারের পাশ দিয়া প্রায় ১০০টি কাজী পেয়ারার গাছ রোপণ করিয়া তাহার পরিচর্যায় তদারকি করিতেন মহাশয় স্বয়ং। গাছগুলো যেমন হৃষ্টপুষ্ট হইল, তেমনি ডাঁসা পেয়ারাও ধরিল। গাছে গাছে রসালো পেয়ারা ঝুলিতে দেখিয়া, রসনা নিয়ন্ত্রন করিয়া শ্রেণিকক্ষে পাঠ লওয়া বড়ই অসম্ভব হইয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু উপায় তো নাই , উহার প্রতি নজর পড়িবা মাত্রই, আড়াই হাত লম্বা আর আধা ইঞ্চি ব্যাসার্ধের জালী বেতখানি ঠুসি হইয়া মুখে আটকাইয়া যাইত। এই ঠুসিই সাড়ে আটশত ছাত্রের হাত হইতে ঐ ডাঁসা পেয়ারা রক্ষা করিত বটে। একদা বিজ্ঞানাগারে অরবিন্দু স্যারের ( অরবিন্দু সরদার , বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, খুলনা জেলায় কয়েকবার শ্রেষ্ঠ গণিত শিক্ষকের তকমাধারী) জীববিজ্ঞান পাঠদান চলিতেছে। হঠাৎ ছাত্রাবাসের সিড়ির ধারে একটি টসটসে পেয়ারা নজরে আসিল। লোভ সামলাইতে না পারিয়া শামীমকে বলিলাম, ‘এই পেয়ারা আজি খাইতেই হইবে’ শুনিয়া তাহার কণ্ঠনালী বোধকরি শুকাইয়া উঠিল, সে আমাকে আড়াই হাত বেত আর শাস্তির স্বরূপ শুনাইয়া নিজ দায়িত্বে এই ভয়ংকার কর্ম করিবার উপদেশ দিয়া, নিজকে উহা হইতে বিরত রাখিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিল। মূত্র বিসর্জনের ছল করিয়া বাহিরে আসিয়া, লোভিত ফলের দিকে হাত বাড়াইতেই সেই আড়াই হাত বেতের প্রতিচ্ছবি আর উহা ব্যবহারকারীর অগ্নিমূর্তি চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংবরণ করিলাম বটে কিন্তু রসনা তাহা শুনিল না। শেষমেশ না ছিড়িয়া ফল গাছে রাখিয়াই খাইতে আরম্ভ করিলাম। এক কামড় লইয়া কিছুদুর হাঁটিয়া আসিয়া আবার আর এক কামড় লইয়া আসিলাম। অর্ধেক শেষ করিয়া ক্লাসে গিয়া বসিলাম। শামীম উহা শুনিয়া, অবাক হইল কি ভয় পাইল তাহা বুঝিলাম না, কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে উহা সমস্ত স্কুল রাষ্ট্র হইল। অতি উৎসাহিতরা উহা লইয়া গবেষণা করিতে বসিল। মহাশয় সঙ্গীয় কর্মচারী, কর্মকর্তা লইয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিয়া বৃদ্ধ মালীকে বিস্তর ধমকাইল এবং এই আধ খাওয়া জীবন্ত ঝুলন্ত ফলের রহস্য উদঘাটন না হইলে, যে তাহার চাকুরী চলিয়া যাইতে পারে তাহা পরিষ্কার বলিয়া দিল। ঐ অভিনব চোর ধরিবার জন্য বহু চেষ্টা করা হইল, পুরুস্কার ঘোষনা করা হইল কিন্তু দিনের আলোয় চলাচল যোগ্য কোন ভিনদেশী বাদুড় ছাড়া আর কাহাকেও সাব্যস্ত করা গেল না।
আমরা রত্নগর্ভা মাতার নাম শুনিয়া থাকি কিন্তু রত্নহস্ত পিতার নাম কি কখনো শুনিয়াছি? পাঠক ধৈর্যহারা না হইয়া নিম্নের প্রচ্ছদ কয়টি পড়িলেই হয়ত এক রত্নহস্ত পিতার পরিচয় পাইবেন।
মহাশয়ের ঐকান্তিকতায় এই বিদ্যা সরোবর যশোর শিক্ষা বোর্ডের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় অনেক পূর্বেই নাম লিখাইয়াছিল। তাঁহার কর্মকালীন সময়ে বোর্ডের মেধা তালিকা সহ পাশের হার ও ছাত্র সংখ্যাও ছিল ঈর্ষণীয়। বিদ্যাদেবের হাতে গড়া রত্নগুলো দেশবিদেশে উচ্চ পদমর্যাদায় আসীন। তিনি শুধু বিদ্যা রত্নই আবিস্কার করেননি, তাঁহার হাতে তৈয়ারি হইয়াছিল দেশসেরা খেলোয়াড় আর জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত স্কাউট দল। স্বর্ণকাপ আর রৌপ্যকাপের বিরাট আয়োজনের আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট এই বিদ্যালয় ব্যাতিত, বাংলায় অন্য কোথাও হইতো বলিয়া আমার জানা নাই।
স্কাউট সদস্য হিসাবে পেট্রোল লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ( শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন, এস এস সি- ৯৩, লিডস কর্পোরেশনে এ জি এম পদে কর্মরত ) নেতৃত্বে ২বার উপজেলা সমাবেশ, ২বার জেলা সমাবেশ, একবার বিভাগীয় সমাবেশ এবং আমার নেতৃত্বে একবার বিভাগীয় সমাবেশে অংশগ্রহণ করিবার সৌভাগ্য এই অধমের হইয়াছিল। ৬বারের মধ্যে ৫বারই আমাদের দল শ্রেষ্ঠ স্কাউট দলের স্বীকৃতি পাইয়াছিল। চৌকস দলনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায়, সমাবেশ লিডার হিসাবে ৪ বার দায়িত্ব পালন করিয়াছিল এবং শ্রেষ্ঠ পেট্রলিডারের তকমাও পাইয়াছিল। এই সময় ৬০ জনের এক বিশাল স্কাউট দল ছিল স্কুলে এবং স্কাউটদের মান উন্নয়নে সাপ্তাহিক প্রশিক্ষন ও আলাদা ক্লাস ও হইত। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হওয়ায়, জনাব আমাদিগকে জাতীয় জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করিতে না দিলেও আমাদের পূর্বে অনেক দলই জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ ও সুনাম অর্জন করিয়াছিল বৈকি।
হেডস্যারের লিখিত সেই জারিগানে আর সঞ্জয়ের (সঞ্জয় দাস, এস এস সি-৯৪) খোলের তালে নাচিয়া অনুপম’দা (ইঞ্জিনিয়ার অনুপম পাল,এস এস সি- ৯৩) ও আলতাফ হোসেন (শেখ আলতাফ হোসেন, এস এস সি-৯৭) তাবু জলসার বিচারকদের কুপোকাত করিয়া ফেলিতো।